তিনটি কবিতা । দেবাশীষ অধিকারী

দেবাশীষ অধিকারী। কলম এর তীক্ষ্ণ ফলা। মুক্তাক্ষর সাহিত্য স্রোত এর প্রতিষ্ঠাতা। তার লেখায় ভারত-বাংলাদেশ ছড়িয়ে পড়েছি আমরা। তিনটি কবিতা রইল তার।


১.
সবাইকে ফাঁকি দেওয়া যায় না

দেবাশীষ অধিকারী


তুমি না বড্ড বোকা,
ভেবেছিলে আমায় ঠকাবে।
জানো না যে চাইলেই সবাইকে ঠকানো যায় না,
হারানো যায় না।
কেউ কেউ ইচ্ছে করেই হারে প্রিয় মানুষটিকে
জিতিয়ে দিতে। 
না,দয়া নয়,ভালোবেসে।
এই যে প্রতি রাতে তোমার দাম্ভিক সত্তার চোখে ফাঁকি দিয়ে তুমি আমায় ছুঁয়ে যাও,
শিরায়-শিরায় ছড়িয়ে দাও তোমার মৃতসঞ্জীবনী সুরা
তা কি তুমি জানো?
গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে তৃষিত তাপিত মাটিতে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাকে নিমেষে উধাও হতে দেখেছো কখনো?
মাটি কি ভী...ষণ তৃষ্ণায় সে ফোঁটার সবটুকু নিংড়ে নেয়
সেভাবে দেখেছো কখনো?
এখন প্রত্যেক রাতে তোমার অদৃশ্য উপস্থিতি আমি সেই রুক্ষ শুষ্ক মাটির মতোই শুষে নেই।
জানো? মনে-মনে ভারি মজা হয়--
তুমি চেয়েছিলে আমায় ফাঁকি দিতে,ঠকাতে
কিন্তু তোমার তুমি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এখনো আমায় ভরিয়ে দেয়।
যদি কোনদিন এই সত্যটা জানতে পারো
সেদিন হয়তো বা বুঝবে -
সবাইকে ফাঁকি দেওয়া যায় না,
তুমিও পারোনি।



২.
অন্বেষণ

দেবাশীষ অধিকারী


চারিদিকে শঠ, তঞ্চক, মুখোশধারী আর স্তাবকের ভিড়।
আকন্ঠ বিষে বাংলার মাটি নীলকন্ঠ।

এক মুঠো স্বচ্ছতার সন্ধানে বারবার মুঠো ভরা বিষ,
তবু সন্ধানী চোখ পথে-পথে।

বিষের বিশ্বায়নে সংস্কৃতিক জগতে মুক্ত বাতাসের খোঁজ
জীবনের আরও এক বড় ভুল।
সেখানেও ব্যান্ডেজে ঢাকা পরিচিত ঘা।

বিস্তর পথ চলা,শতবার ভুলে
বারবার অলিন্দের রক্তক্ষরণ বিষাক্ত হুলে,
তবু অনুভবের বড় প্রাপ্তি --
ফেলে আসা জীবন সবচেয়ে বড় শিক্ষক।
তার চোখে দেখি পরম সত্য -
দুনিয়া ভরে ,যত অনাসৃষ্টি, মলিনতা,
লেজ ধরে খুঁজে দেখি এসবেরই আঁতুর ঘর
আমাদের মাথা।

দগদগে ঘা যে পায়ে,
সে ঘায়ের সৃষ্টিও মাথাতে,
কঠিন আবরণে সুকৌশলে ঢাকা বলে
যায়নি দেখা, পারেনি গন্ধ ছড়াতে।
পচা গলার স্রোত নিম্নমুখী হতে হতে
পায়ে এসে দৃশ্যমান।
তাই দুর্নীতি রুখতে হাত নয়,পা নয়,
মাথা ছাটা প্রয়োজন।



৩.
এক কোটি বছর

দেবাশীষ অধিকারী


এইতো সেদিনই তুই পাশে ছিলি 
মাঝখানে কটা দিন আর কেটেছে একেলা বল?
তবু মনে হয় এক কোটি বছর দেখিনি তোকে,
এক কোটি বছর...।
তুই যাবার পর আমার প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের ভালোবাসা গুলো যা তোকে দেবার কথা ছিল
সেগুলো সব বুক পকেটে জমা করতাম।
এখন মস্ত বড় এক পোটলা  পিঠে বয়ে চলি,
যখনই তোকে দেখতে ইচ্ছে হয়,তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়,ভীষণ ভালোবাসতে...
তখন আমার সব ইচ্ছে, সব ভালোবাসা জমা করি সেই পোটলাতে।
জানিস দিন-দিন বোঝাটা না ভীষণ ভারী হচ্ছে রে,
আমি আর বইতে পারিনা,কষ্ট হয়,শিরদাঁড়া নুয়ে পড়ে, কুঁজো হয়ে যাই।
বিশ্বাস কর, তবু যা তোর ,তার উপরে আজও তোর নিঃশেষ অধিকার,থাকবে অনন্তকাল।
হয়তোবা এক কোটি বছর 
কথা দিয়েছিলেম যে,দশ বছর, কুড়ি বছর, তিরিশ  বছর পরেও আমি আমিই থাকবো 
যত কষ্টই হোক,ওই বোঝা আমি ছাড়ছি না।
কুঁজো  হতে-হতে হয়তো একদিন হামাগুড়ি দেবো,
তারও পরে শুয়ে-শুয়ে দন্ডি কেটে চলবো।
ঘর্ষণে ক্ষয়ে-ক্ষয়ে আমি ছোট হতে থাকবো ,
ক্রমে ছোট...থেকে ছোট, আরো.... আরো ছোট,
তারপর একদিন রাজার মতো চতুর্দলায়  চড়ে চলে যাব।
আমি ফুলে-ফুলে  ঢাকা পড়ে থাকবো,
যাত্রা পথে খই,পয়সা,ছাড়ানো হবে,
আমার এই তুচ্ছ অদামী শরীরটা দামি সাবান,ঘী মধুতে চকচক করে উঠবে,
অগুরু আর আগরবাতির সুগন্ধে আমার চারপাশ ম ম করবে।
সে এক রাজকীয় ব্যাপার!
ভাবতেই আনন্দে চোখের কোনে জল আসে।
দুঃখ একটাই, সেদিন যদি তুই ভুল করেও আমার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে বলে উঠিস
বন্ধু আমি এসেছি, আমি আজ তোমায় চিনেছি
পেয়েছি নতুন করে
সেই দুর্লভ  মুহূর্তকে চাক্ষুস করার জন্য একবারও আমার চোখের পাতা খুলবে না
অনুভব করাতে এক মুহূর্তের জন্যও হৃদযন্ত্র চালু হবে না,
আমার নিথর শীতল দেহের উপর দিয়ে সবকিছুই হাওয়ায় ভেসে যাবে।
একটু পরেই যে আধুনিক প্রযুক্তিতে খুব অল্প সময়ে আমি ছাই হয়ে যাব।
আর সেই সঙ্গে মুক্তি পাবে আমার বস্তা বন্দী ভালোবাসা গুলো, বুকের ভেতরে চেপে বসে থাকা তোকে হারাবার অসহ্য যন্ত্রণা,আমার মন খারাপের সাথে সহবাস, অসহায় নীরবতা, আমার একাকীত্ব সব,সবকিছু মুক্তি পেয়ে যাবে।
সেদিন থেকে তুইও ও মুক্ত আমার অন্তরের কারাবাস থেকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ